সূরা নসরের নামকরণ, তাফসীর ও শিক্ষা আলোচনা তুলে ধরা হল।
নামকরণ ও গুরুত্ব: النصر শব্দের অর্থ সাহায্য, সহযোগিতা। এ শব্দটি প্রথম আয়াতেই এসেছে, সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরার অপর নাম সূরাতুত তাওদী বা বিদায়ের সূরা। এ সূরাতে নাবী (সাঃ)-এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে বিধায় এর নাম সূরাতুত্ তাওদী করা হয়েছে। (তাফসীর মারেফুল কুরআন)। এ সূরাটি অবতীর্ণের দিক দিয়ে সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। (ফাতহুল বারী ৮/৬০৫, সহীহ মুসলিম হা. ৩০২৪) ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আইয়ামে তাশরীক (১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জের) মাঝামাঝি দিনে মিনায় এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হাজ্জে ছিলেন। সূরাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বুঝতে পারলেন যে, এটাই তাঁর শেষ হাজ্জ, অতঃপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন। (ইমাম বায়হাকী তার দালায়েল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন হা. ৯৪৬৪) আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : (إِذَا جَا۬ءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَالْفَتْحُ) সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার পর নাবী (সাঃ) যে সালাতই আদায় করতেন তাতে سبحانك ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي -পাঠ করতেন। (সহীহ বুখারী, হা. ৪৯৬৭, সহীহ মুসলিম হা. ৪৮৪) অন্য বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রুকু ও সিজদাতে এ দু‘আটি বেশি বেশি পড়তেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৬৮) কারণ এ সূরা কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৭৩১) এ সূরার ফযীলত সূরা যিলযালে আলোচনা করা হয়েছে। তাফসীর: إِذَا সাধারণত শর্তের অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যখন তুমি সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইবে। (তিরমিযী হা. ২৫১৬, মিশকাত হা. ৫৩০২, সহীহ) তবে নিশ্চয়তার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে সে অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। (نَصْرُ اللّٰهِ) বলতে কুফর ও কাফিরদের ওপর ইসলাম ও মুসলিমদের বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। الْفَتْحُ দ্বারা মক্কা বিজয়কে বুঝানো হয়েছে যা ৮ম হিজরীর ১৭ই রমাযান মঙ্গলবার সকালে অর্জিত হয়েছিল। এ সূরাতে কয়েকটি বিষয় আলোচনা স্থান পেয়েছে: ১. সুসংবাদ : এ সুসংবাদটি হলো ইসলাম, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলিমদেরকে সাহায্য করার সুসংবাদ এবং মক্কা বিজয় ও দলে দলে দীন ইসলামে মানুষের প্রবেশের সুসংবাদ। এ সুসংবাদটি ইতোমধ্যে সংঘঠিত হয়ে গেছে। মক্কা বিজয়ের পরের বছর ৯ম ও ১০ম হিজরীকে প্রতিনিধি দলের আগমনের বছর বলে আখ্যায়িত করা হয়। ঐ সময় আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দলে দলে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে ইসলাম গ্রহণের অন্যতম কারণ হল হারাম শরীফকে আল্লাহ তা‘আলা হস্তীবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সে হারামের তত্ত্বাবধায়কদের ওপর যখন মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি সত্য নাবী। (সহীহ বুখারী হা. ৪৩০২) ইকরিমা ও মুকাতিল (রহঃ) বলেন : (نَصْرُ اللّٰهِ) বা বিজয় বলতে ইয়ামানী প্রতিনিধি দলের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা তাদের প্রায় সাতশত লোক মুসলিম হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে, কেউ কালেমা পড়তে পড়তে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুবই খুশি হন। কিন্তু উমার ও আব্বাস (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। (তাফসীর কুরতুবী) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : نَصْرُ اللّهِ বিজয় এসেছে, সাহায্য এসেছে এবং ইয়ামানবাসীরাও এসেছে। জনৈক ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহর রাসূল! ইয়ামানবাসী কারা? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : جَاءَ أَهْلُ الْيَمَنِ، هُمْ أَرَقُّ أَفْئِدَةً، الْإِيمَانُ يَمَانٍ، وَالْفِقْهُ يَمَانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ ইয়ামানবাসীরা আগমন করেছে, এদের হৃদয় খুবই নরম। ঈমান ইয়ামানবাসীদের মাঝে, বুঝশক্তি ইয়ামানবাসীদের এবং দূরদর্শিতা ইয়ামানবাসীদের মাঝেই। (সহীহ মুসলিম হা. ৫২) ২. সূরাতে দুটি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। একটি ইঙ্গিত হলো : আল্লাহ তা‘আলার এ সাহায্য বলবত থাকবে এমনকি তা আরো বৃদ্ধি পাবে যদি মানুষ প্রকৃত ঈমান ও আমলে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর প্রমাণ খুলাফায়ে রাশেদা ও তার পরবর্তী যুগ। আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য নিয়েই খুলাফায়ে রাশেদাগণ ও পরবর্তী মুজতাহিদগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। দ্বিতীয় ইঙ্গিত হলো : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইনতেকালের সময় নিকটবর্তী। এজন্য তিনি সালাতের মাঝে রুকু ও সিজদাতে বেশি বেশি তাসবীহ পাঠ করতেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী বয়স্ক মুজাহিদদের সাথে উমার (রাঃ) আমাকেও শামিল করে নিতেন। এ কারণে কারো মনে সম্ভবত অসন্তুষ্টির ভাব সৃষ্টি হত। একদা তাদের মধ্যে একজন আমার সম্পর্কে মন্তব্য করে বলল : সে কেন আপনার সাথে আসে? আমাদেরও তো তার মত সন্তান আছে। উমার (রাঃ) বললেন : তোমরা তো তার ব্যাপারে ভাল করেই জান। একদিন তিনি সবাইকে ডাকলেন এবং আমাকেও তাদের সাথে প্রবেশ করালেন। আমি বুঝতে পারলাম আজ তিনি তাদেরকে কিছু দেখাতে চান, উমার (রাঃ) সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন : তোমরা (إِذَا جَا۬ءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَالْفَتْحُ) এ আয়াতটির ব্যাপারে কী বল? তাদের কতকজন বললেন : যখন বিজয় ও সাহায্য আসবে তখন আমাদেরকে তাসবীহ, তাহলীল ও ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর কতকজন চুপ থাকলেন, কোন কথা বললেন না। এবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তুমি এরূপই বল, হে ইবনু আব্বাস? আমি বললাম : এ সূরায় নাবী (সাঃ)-এর পরলোক গমনের কথা বলা হয়েছে। এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাঁর ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে এসেছে। এ কথা শুনে উমার (রাঃ) বললেন : আমিও তাই বুঝেছি (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৭০)। (فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ) অর্থাৎ তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর। প্রশংসা বা হামদ হল ভালবাসা ও সম্মানসহকারে পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার গুণকীর্তন করা। আর পবিত্রতা হল আল্লাহ তা‘আলার শানে উপযুক্ত নয় এমন সব কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। এ আয়াতে উভয়টার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এ সূরা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বেশি বেশি ইসতিগফার পড়তেন। প্রশ্ন হতে পারে; রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর তো পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে তবুও কেন তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হল?
উত্তর : এরূপ প্রশ্ন আয়িশাহ (রাঃ) করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বলেন : أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا আমি কি আল্লাহ তা‘আলার একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (সহীহ বুখারী হা. ১১৩০) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : এর মধ্যে উম্মাতের শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, তারা যেন নিরাশ না হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা ছেড়ে না দেয়। তিনি বলেন : নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও যখন তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন তখন অন্যদের কেমন ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। (তাফসীর কুরতুবী) সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন সেজন্য তাঁর শুকুরগুজার হওয়া উচিত এবং বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সূরা নাছর কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। ২. সূরা নাছরে মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। ৩. মৃত্যু নিকটবর্তী মনে হলে বেশি বেশি তাসবীহ ও ইসতেগফার করা উচিত। ৪. ছোটরাও অনেক সময় বড়দের থেকে বেশি জ্ঞান রাখে।
Comments
Post a Comment